এম. মনছুর আলম, চকরিয়া:

আজ থেকে ২৭বছর আগে ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল এইদিনে কক্সবাজারের চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলাসহ উপকূলীয় অঞ্চলে নেমে আসে মহাপ্রলয়ংকারী ঘুর্ণিঝড়। সর্বনাশা তান্ডবে ধংস হয়ে যায় উপকুলের মানব সভ্যতা। মৃত্যু ঘটে হাজারো মানুষের।সেই দিনের জ্বলোচ্ছাসের মহাপ্লাবনের তান্ডবে গৃহপালিত পশু, মৎস্য সহায় সম্পদসহ মাথা গুজানোর ঠাঁই ঠুকুও হারায় হাজার হাজার পরিবার। রাস্তাঘাট, বনজ সম্পদসহ নানা ক্ষেত্রে ঘটে ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি। ঘুর্ণিঝড়ের পর ২৭টি বছর সময় অতিক্রম হলেও ক্ষতিগ্রস্থ জনগন এখনো নিজেদের ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পারেননি। বছরঘুরে দিনটি প্রতিবছর জনগনের সামনে উপস্থিত হলেও এতদিন ভাগ্য বদল হয়নি এতদাঞ্চলের মানুষের।

চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলার উপকুলীয় অঞ্চলে ঘুর্ণিঝড়ে সামাজিক নিরাপত্তার অন্যতম উৎস হচ্ছে সাইক্লোন শেল্টার। গেল ২৭ বছরে এখানে নির্মিত হয়নি পর্যাপ্ত সাইক্লোন শেল্টার। বর্তমানে এসব সাইক্লোন সেল্টার যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে হতশ্রী ও ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এছাড়া এসব সাইক্লোন সেল্টার রক্ষণাবেক্ষণ কোন সংস্থা করবে তা ২৭ বছর পরও নির্ধারণ করা হয়নি।

ফলে বেশিরভাগ সাইক্লোন সেল্টার দাবীদার বিহীন সম্পদে পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের অধীনে উপজেলা পর্যায়ে নির্মিত সাইক্লোন সেল্টারগুলো বাস্তব অবস্থা যাচাইয়ে জরীপের কাজ করা হয়।অপরদিকে স্থানীয় সরকার বিভাগের (এলজিইডির) অধীনে চকরিয়ায় ১০টি ও পেকুয়া উপজেলায় সাতটি বিদ্যালয় কাম সাইক্লোন সেল্টার নির্মাণ করা হচ্ছে।

উপকূলবাসীকে রক্ষার জন্য সরকার ও এনজিও সংস্থার বেড়িবাধের পাশে প্যারাবন (সবুজ বেষ্টনী) গড়ে তুললেও এখন বেশিরভাগ উজাড় হয়ে গেছে। অপরদিকে কিছু লোভী চিংড়ি চাষি উপকূলীয় এলাকার সবুজ বেষ্টনী (প্যারাবন) উজাড় করে চিংড়ি ঘের করে যাচ্ছে। অনুরূপভাবে উপকূলবাসীকে রক্ষার জন্য এখনো নির্মাণ হয়নি টেকসই বেঁড়িবাধ।ফলে এখনো অরক্ষিত রয়েছে উপকুলীয় জনপদের অন্যতম নিরাপত্তা বেস্টনী বেড়িবাঁধ সমুহ। এ অবস্থার কারনে দুই উপজেলার প্রায় ৫ লাখ মানুষ এখনো ঘুর্ণিঝড় আতংকে রয়েছেন।

পশ্চিম বড় ভেওলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বাবলা বলেন, ইউনিয়নের চৌয়ারফাঁড়ি হতে সোলতান মিয়ার খামার পর্যন্ত ১৪ চেইন বেড়িবাঁধ এখনও অরক্ষিত। ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের মত প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলেই পুরো এলাকায় বিপর্যয়ের আশংকা রয়েছে।

স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জানান, সাইক্লোন শেল্টারের চেয়ে উপকুলীয় অঞ্চলে সামাজিক নিরাপত্তার মুল বলয় হচ্ছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধ ও উপকুলীয় বনবিভাগের প্যারাবান। কিন্তু সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের উদাসীনতার ঘুর্ণিঝড়ের এতবছর পরও অরক্ষিত রয়েছে উপকূলীয় অঞ্চলের রক্ষাকবচ বেড়িবাঁধের বিশাল এলাকা। যার ফলে উপকুলীয় অঞ্চলে জনগনের মাঝে এখনো আতঙ্ক তাঁড়া করে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড কক্সবাজার সুত্রে জানা গেছে, কক্সবাজার পাউবোর ২১টি পোল্ডারের অধীন জেলার আট উপজেলায় ৫৯৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। ১৯৯১সালের প্রলয়ংকারী ঘুর্ণিঝড়ে উপকুলীয় অঞ্চলের বেশিরভাগ বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। অনেক এলাকায় উচুঁ বেড়িবাঁধ মিশে গেছে মাটির সাথে। তবে পাউবো প্রতিবছর অধিক ঝুকিঁপুর্ণ এলাকা চিহিৃত করে প্রাপ্ত অর্থ বরাদ্দের বিপরীতে ক্ষতিগ্রস্থ বেড়িবাঁধ সংস্কারে কাজ করছেন।

কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের চকরিয়া শাখা কর্মকর্তা (এসও) তারেক বিন সগীর বলেন, চকরিয়া উপজেলায় পাউবোর চারটি পোল্ডারের অধীনে ৮০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। তারমধ্যে বর্তমানে ১১ কিলোমিটার অধিক ঝুঁকিপুর্ণ বেড়িবাঁধের সংস্কার কাজ চলছে। এছাড়া আরো বেশি ঝুকিঁপুর্ণ ১২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ মেরামতে অর্থবরাদ্দের জন্য পাউবোর উর্ধ্বতন প্রশাসনে প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে। তিনি বলেন, অর্থবরাদ্দ নিশ্চিত হলে এসব বেড়িবাঁধের মেরামত কাজ শুরু করা হবে।

বান্দরবান পানি উন্নয়ন বোর্ডের পেকুয়া উপজেলা শাখা কর্মকর্তা (এসও) গিয়াস উদ্দিন বলেন, পেকুয়া উপজেলার মগনামা, রাজাখালী, সদর ও উজানটিয়া ইউনিয়নে পাউবোর পাঁচটি পোল্ডারের অধীনে ১২০ কিলোমিটারের মধ্যে প্রায় ৮০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ বর্তমানে রক্ষিত অবস্থায় আছে।তারমধ্যে বেশি ঝুঁকিপুর্ণ ২০ কিলোমিটার অংশে বর্তমানে মেরামত কাজ চলছে। আরো ২০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ জরুরী ভিত্তিতে সংস্কারের প্রয়োজন আছে এই ধরণের সারসংক্ষেপ তৈরী করে অর্থবরাদ্দের জন্য আবেদন পাঠানো হয়েছে।

চকরিয়া উপজেলা রেড ক্রিসেন্ট কর্মকর্তা মনির চৌধুরী বলেন, ৯১সালের ঘুর্ণিঝড়ের পর সরকারি ও বেসরকারি সাহায্য সংস্থার অনুদানে চকরিয়ায় ৮১টি ও পেকুয়া উপজেলায় ৫৩টি সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণ করা হয়। এগুলোর বেশির ভাগ বর্তমানে ব্যবহৃত হচ্ছে বিদ্যালয় কাম সাইক্লোন শেল্টার হিসেবে।

দু’উপজেলার জনসংখ্যা অনুপাতে পর্যাপ্ত পরিমাণ সাইক্লোন শেল্টার প্রয়োজন থাকলেও বর্তমানে ২০ থেকে ২৫টি মতো সাইক্লোন শেল্টার ব্যবহার অনুপযোগি। অবশিষ্ট গুলোতে দুযোর্গ মুর্হুতে দুই উপজেলার জনসাধারণ কোনমতে নিরাপদ আশ্রয়ে যাচ্ছে।

চকরিয়া পেকুয়া আসনের সংসদ সদস্য হাজি মোহাম্মদ ইলিয়াছ কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলার পাঁচ লাখ মানুষের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে পরিকল্পিতভাবে কাজ চলছে। বর্তমানে ৩১৭ কোটি টাকা ব্যয়ে দুই উপজেলার উপকুলীয় অঞ্চলে বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও সংস্কার কাজ চলছে। পর্যায়ক্রমে অধিক ঝুঁকিপুর্ণ বেড়িবাঁধ গুলো নির্মাণ করা হবে।

তিনি বলেন, দুযোর্গ কালীন সময়ে যাতে লোকজন নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যেতে পারে সেইজন্য পুরাতন সাইক্লোন সেল্টার গুলো সংস্কার করা হচ্ছে। পাশাপাশি এবছর চকরিয়া উপজেলার ১০টি ও পেকুয়া উপজেলার সাতটি নতুন সাইক্লোন সেল্টার কাম বিদ্যালয় নির্মাণ করা হচ্ছে বলে তিনি জানান।